সাধারন ভাবে আমরা যে রাস্তা গুলো দেখি থাকি তার বেশীর ভাগই হয় বিটুমিনাস সড়ক। এবং এসব সড়কে ব্যাবহার করা হয় ব্রিক ফ্ল্যাট সলিং যার ফলে ব্যবহৃত হয় প্রচুর পরিমান পোড়ামাটির ব্রিক। আর এই ইট ব্যবহার করে সড়ক ও স্থাপনা নির্মাণের ফলে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে ।
মূলত ব্রিক বার্নিং এর কারনে পরিবেশের বায়ু দূষন হয় ব্যাপক ভাবে আবার এই ইট তৈরিতে মাটির টপ সয়েল কেটে ভাটাগুলো ইট তৈরী হয় যার ফলে বিপুল পরিমাণ আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। দেশে বর্তমানে ইটভাটার সংখ্যা ৬ হাজার ৯৩০টি আর বছরে দেশে ইটের চাহিদা প্রায় দুই হাজার কোটি। যার বেশির ভাগই কৃষিজমির উপরিভাগ (টপ সয়েল) থেকে সংগ্রহ করা হয়। ইট প্রস্তুত কারক মালিক সমিতির হিসাব অনুযায়ী জানা গেছে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২.৫ হাজার কোটি পোড়া মাটির ইট তৈরি করা হয়,যে জন্য ৩৮০০ হেক্টর কৃষি জমির কেটে নেওয়া হয়। শুধু তাই নয় এইসব মাটি পোড়ানোর জন্য ৫০ লক্ষ টন কয়লা এবং ৩০ লক্ষ টন কাঠ ব্যাবহার করা হয়। যার ফলে বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট হচ্ছে।

এসব বিষয়কে সামনে রেখে বাংলাদেশ সরকার ২০২৪ সালের মধ্যে গ্রামীণ সড়কে বিটুমিনাস কার্পেটিং এবং ইটের ব্যবহার না করে ব্যাপক ভাবে ইউনি ব্লকের ব্যবহার করতে চাচ্ছে।আর তারই ধারাবাহিকতায় দেশে প্রথমবারের মতো বিটুমিনাস এবং সাধারণ ইটের সড়কের পরিবর্তে বালু এবং পাথরের তৈরী পরিবেশবান্ধব ইউনি ব্লক দিয়ে সড়ক তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এল.জি.ই.ডি) দেশের বিভিন্ন জায়গায় ইউনি ব্লকের সড়ক নির্মানের উদ্যোগ নিয়েছে।
ইউনি ব্লক কিঃ
পরিবেশের উপর ইটের ক্ষতিকারক দিকের কথা চিন্তা করে ইটের বিকল্প ও সল্প ব্যায়ে নির্মান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছে বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং রিসার্চ ইনিস্টিটিউট (এইচবিআরআই)।
এই প্রতিষ্ঠানের গবেষণার পর ইটের বিকল্প হিসেবে চিন্তা করে কনক্রিটের ব্লক তথা ইউনি ব্লক। এই ব্লক নির্মাণ করা হয় সিমেন্ট ও নুড়ি পাথর দিয়ে। ইটের মতো পোড়াতে হয় না। যার ফলে পরিবেশ ও জলবায়ুর ও কোনো ক্ষতি করেনা।

ইউনি ব্লকের বৈশিষ্ট্যঃ
বাংলাদেশে বিভিন্ন কোম্পানি ইউনি ব্লক তৈরি করে থাকে । এবং বিভিন্ন কোম্পানির ইউনি ব্লকের বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে ,তবে কম-বেশী নিচের বৈশিষ্ট্য গুলো থাকতে হবে।
ব্লক সাইজ : (২২২ x ১১০ x ৬০ )এমএম
ওজন : ৩.২৫ কেজি
পানি শোষণ ক্ষমতা : (৩-৫) %
ক্রাশিং ক্ষমতা : ৩০-৩৫ এমপিএ
প্রতি ১ স্কয়ার মিটার বসে : ৪০ পিস্
কোথায় ব্যাবহার হয় ইউনি ব্লকঃ
ইউনি ব্লক দিয়ে সড়ক , ফুটপাত,পার্কিং এরিয়া, প্লাজা, কোর্ট ইয়ার্ড ইত্যাদির পেভমেন্ট তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। পরিবেশবান্ধব এই ব্লকগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া দীর্ঘদিন টিকে থাকে।
* গ্রামীন সড়ক।
* অভ্যন্তরীন সড়ক ,ফুটপাথ ,বাস স্ট্যান্ড বা বাস স্টপেজ এ এই ব্লক ব্যাবহার করা যায়।
* কারপার্কিং,ভারী মালামাল রাখার জায়গা ইত্যাদি স্থানে পেভিং ব্লক ব্যাবহার করা যায়।
* পেভিং ব্লক বসানোর জন্য কোনো RCC ঢালাই প্রয়োজন নাই শুধু বালুর বেডতৈরি করে এই ব্লক বসানো যায়।

বাংলাদেশে ইউনি ব্লকের সড়ক নির্মানঃ
সরকারের গ্রামীণ সড়কে বিটুমিনাস কার্পেটিং এবং ইটের ব্যবহার না করে ব্যাপক ভাবে ইউনি ব্লকের ব্যবহার করার উদ্যোগ কে সামনে রেখে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্ত্র-এলজিইডি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইউনি ব্লকের সড়ক নির্মান করছে।
এরই মধ্যে সম্প্রতি দেশে প্রথমবারের মতো নাটোরে এরকম একটি সড়ক নির্মান করা হয়েছে,যেখানে বিটুমিনাস এবং সাধারণ ইটের পরিবর্তে বালু এবং পাথরের তৈরী পরিবেশবান্ধব ইউনি ব্লক এর সড়ক নির্মান করেছে নাটোরের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। একইভাবে দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও এলজিইডি বিভিন্ন গ্রামীন সড়ক গুলোতে ইউনি ব্লক ব্যাবহার করে কাজ করছে।

ছবিঃ নাটোরে পরিবেশবান্ধব ইউনি ব্লক দিয়ে এলজিইডির তৈরী করা দেশের প্রথম সড়ক
কেনো ইউনি ব্লক সড়কঃ
পরিবেশবন্ধব এসব ইউনি ব্লকের ব্যবহার বাড়লে ইটের ব্যবহার বন্ধ হবে এবং দেশের আবাদি জমি রক্ষা পাবে, পরিবেশ দূষণ কমবে ,এগুলো ছাড়াও এই ইউনিব্লকের স্ট্রাকচারাল এবং গুনগত আরো অনেক সুবিধা রয়েছে।
সুবিধা :
* ইটের তুলনায় অধিক তাপ ,শব্দ সহ্য করার ক্ষমতা বেশি এবং পানিতে কম ক্ষতি হয়।
* সাধারন ইটের তুলনায় স্ট্রেন্থ অনেক বেশী হয়ে থাকে, সাধারণ ইটের চাপ নেয়ার ক্ষমতা ১৭ এমপিএ হলেও ইউনি ব্লকের ৩০-৩৫ এমপিএ চাপ নেয়ার ক্ষমতা আছে
* বর্ষায় বিটুমিনের কাজ করা যায়না। কিন্তু ইউনি ব্লক দিয়ে বর্ষায়ও কাজ করা যাচ্ছে।
* বৃষ্টিতে বা জলাবদ্ধতায় বিটুমিনের সড়ক নষ্ট হলেও ইউনি ব্লক দিয়ে তৈরী সড়ক নষ্ট হবেনা। ইউনি ব্লক দিয়ে সড়ক নির্মাণ বা সংস্কারের পদ্ধতিও অনেক সহজ।
* ইউনি ব্লকের রাসায় ভেজা রাস্তায় গাড়ি চালালেও কোন স্লিপ করেনা কিন্তু বিটুমিনাস কার্পেটিং সড়কে স্লিপ করে অনেক দুর্ঘটনা হয়।
* তৈল, মবিল এবং গ্রীজে কোন ক্ষতি হয় না এবং বসানোর পর কোন কিউরিং করার প্রয়োজন হয় না
ইউনি ব্লক সড়ক নির্মানে কেমন খরচ হবে?
বিটুমিনাস দিয়ে সড়ক নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হয় প্রায় ৭০ লাখ টাকা। যেখানে ইউনি ব্লক দিয়ে সড়ক নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হচ্ছে ১ কোটি ৪ লাখ টাকা। কিন্তু প্রতি তিন বছরে বিটুমিনাস সড়ক মেনটেনেন্সে খরচ ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা হলেও ইউনি ব্লকে খরচ হবে সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। অর্থাৎ দীর্ঘ মেয়াদী চিন্তায় ইউনি ব্লকের সড়কে কমে আসবে নির্মান ব্যয়।
বাংলাদেশে ইউনি পেভার ব্লকের মূল্যঃ
ইউনিপিভার ব্লক মূলত প্রাকৃতিক বালি, মটর নুড়ি এবং সিমেন্ট দিয়ে তৈরি। এটি নির্মাণের সময়কে অনেকাংশে কমিয়ে আনে। এছাড়াও এটি লবণাক্ততা মুক্ত এবং অগ্নি প্রতিরোধের ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত অনেক বেশী। এছাড়াও এটি পরিবেশ বান্ধব, এত সুবিধা থাকার পরেও ইউনিব্লকের মূল্য অনেক কম। এই দামের পরিসরে, আরও একটি বিষয় হল এই ব্লকটি প্রতিস্থাপনযোগ্য তাই ফুটপাতের মেরামতের কাজ এখন অনেক সহজ হয়্যেছে এবং খরচ ও অনেক কমে এসেছে।
ইট তৈরীতে ভাটাগুলো মাটি অথবা টপসয়েল ব্যবহার করার ফলে আবাদি জমি দিন দিন কমে যাচ্ছে। আর আবাদি জমি কমে যাওয়ার ফলে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। অন্যদিকে ইট ভাটাগুলো জ্বালানি হিসাবে প্রচুর পরিমাণ কাঠ পোড়ায় যার ফলে পরিবেশের উপর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। তাই ইটের ব্যবহার বন্ধ করতে ইউনি ব্লক দিয়ে সড়ক নির্মাণ করা গেলে একদিকে যেমন আবাদি জমিকে রক্ষা করা যাবে, অন্যদিকে পরিবেশ দূষণ কমানো সম্ভব হবে।
লেখাঃ
মোঃ তৌহিদুল ইসলাম
উপজেলা সহকারী প্রকৌশলী
এলজিইডি