মাত্র কয়েক সেকেন্ডের হালকা কম্পন৷ তার উত্সও কয়েকশো কিলোমিটার দূরে৷ তাতেই কেঁপে উঠল ঢাকাবাসী৷ রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গত ২৮ এপ্রিল,২০২১, বুধবার সকাল ৮টা ২১ মিনিটে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর ভূমিকম্পের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৬।

ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ঢাকা থেকে ৩৯৭ কিলোমিটার দূরে আসামে। ভারতের আসামে ৬.২ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। সিলেট থেকে ভূমিকম্প স্থলের দূরত্ব প্রায় ৩৬৮ কিলোমিটার। পঞ্চগড় ,সিলেট এ ভূমিকম্পের তীব্রতা বেশী অনুভূত হয়, ভূমিকম্পে হঠাৎ মাটি ও ঘর-বাড়ি কেঁপে ওঠে। এছাড়া ঢাকা সহ অন্যান্য আশেপাশের জেলায় অনুভূত হয় ভূমিকম্প। এটা আমাদের জন্যে একটা বিশাল সতর্কবার্তা ছিলো।

কয়েক বছর আগেই নেপালের বিধ্বংসী ভূমিকম্পের কথা আমাদের সবারই জানা৷ বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ভূকম্প-প্রবণ এলাকার মধ্যেই অবস্থিত। আগামী দিনে ঢাকা যে বিধ্বংসী ভূমিকম্পের কবলে পড়বে না , তার কোনও নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না ভূ-বিজ্ঞানীরাও ৷ বিগত ২০০ বছরের ইতিহাসে দেখা যায়, বাংলাদেশ ৮টি বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছিল। এর মধ্যে ১৮৮৫ সালের বেঙ্গল ভূমিকম্প ও ১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্পের উৎসস্থল (এপিসেন্টার) ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। বাংলাদেশের অভ্যন্তর ও চারপাশে বেশ কিছু সিসমিক গ্যাপ আছে। একে ভূমিকম্পের উৎসস্থল বলা হয়।ন, ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও বার্মিজ—এই তিন গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। এর মধ্যে ইন্ডিয়ান ও বার্মা প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত সিলেট, যার উত্তরে ‘ডাউকি ফল্ট’। এই প্লেটগুলো সক্রিয় থাকায় এবং পরস্পর পরস্পরের দিকে ধাবমান হওয়ায় এখানে প্রচুর শক্তি জমা হচ্ছে। আর জমে থাকা এসব শক্তি যে কোনো সময় ভূমিকম্পের মাধ্যমে বেরিয়ে আসতে পারে।ফলে অতিমাত্রায় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ।সিলেট, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, কক্সবাজার, ঢাকা ও চট্টগ্রাম জেলা মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল সর্বাপেক্ষা কম ঝুঁকিপূর্ণ। ‘ডাউকি ফল্ট’ ও সিলেট থেকে চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে গত ৫০০ থেকে ১ হাজার বছরে বড় ধরনের কোনো ভূমিকম্পের উৎপত্তি না হওয়ায় সিলেটের সাম্প্রতিক ভূমিকম্প বড় ধরনের ভূমিকম্পের পূর্বাভাস। বাংলাদেশে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার যে মানচিত্র রয়েছে, তাতে সিলেট ও চট্টগ্রাম উচ্চ ঝুঁকিপ্রবণ অঞ্চল। ‘ডাউকি ফল্ট’ লাইনে থাকা সিলেট অঞ্চলে এর আগে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল ১৮৯৭ সালে। রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার ওপরে থাকা সেই ভূমিকম্পে সিলেটে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।সম্প্রতি নেচার জিওসায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরের গবেষকদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভূ-গাঠনিক অবস্থানে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। ঐ গবেষণার বরাত দিয়ে রয়টার্স লিখেছে, এখনই বাংলাদেশ বড় ধরনের ভূমিকম্পে কেঁপে উঠবে এমন কথা বলা না গেলেও দুটি গতিশীল ভূ-গাঠনিক প্লেট পরস্পরের ওপর চেপে বসতে থাকায় সেখানে শক্তিশালী ভূমিকম্পের শক্তি জমা হচ্ছে। এবং যেকোনো সময় মাঝারি কিংবা বড় মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে।
আর যদি ভূমিকম্পের কবলে পড়ে তাহলে ঢাকার পরিণতি কি হবে , তা কম-বেশী সবাই অনুমান করতে পারি ৷ কিন্তু তা নিয়ে এতটুকু চিন্তা নেই শহরবাসীর বা শহরের ভবন মালিকদের৷ ঢাকা সহ প্রধান শহরগুলো তে দশ তলা , আট তলা , ছ’তলা , পাঁচ তলা , চার তলা বাড়ির সংখ্যা হু -হু করেই বাড়ছে৷ কিন্তু এই ধরনের বহুতল ভূমিকম্পের সময় কতটা নিরাপদ ?
আমাদের দেশে যে সব বাড়ি তৈরি হচ্ছে তার সিংহভাগই ভূমিকম্প মোকাবিলায় অপারগ৷ ভবন মালিকরা অনেকটা বিশ্বাসের উপর ভর করেই বাড়ি তৈরি করছেন৷। বর্তমানে কোনও বাড়ি করতে হলে বিল্ডিং প্ল্যানের অনুমোদন দেওয়ার সময় ‘সিসমিক ফোর্স’ যাচাই করা হয়৷ অর্থাৎ, সেটি ভূমিকম্প প্রতিরোধ করতে পারবে কি না , তা খতিয়ে দেখা হয়৷ তবে সিসমিক ফোর্স মেনে বাড়ি তৈরি হচ্ছে কি না । আর তা দেখার দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশন, বিভিন্ন বিভাগের উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, উপজেলা, পৌরসভা সহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার দায়িত্বরত ইঞ্জিনিয়ারদের৷ তাঁরাই হলেন এসব অথোরিটির চোখ -কান৷ কিন্তু এ ব্যাপারে এসব প্রতিষ্ঠানের তেমন কোন নিজস্ব নজরদারি ব্যবস্থা নেই এসব সরকারি সংস্থার। একইসাথে ভবন মালিকদের অনিহার কারনে , যত্রতত্র ডিজাইন ছাড়াই গড়ে উঠছে ভবন। এটা যে কতটা বিপদের দিকে আমাদের কে নিয়ে যাচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।

” ভবন মালিকরা ডিজাইন করিয়ে ইঞ্জিনিয়ারকে টাকা দেওয়াটা কে মনে করেন অনর্থক টাকা খরচ। ভূমিকম্প প্রতিরোধক ব্যবস্থা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনোভাব অনেকটা এরকম যে ভূমিকম্প না হলে তা কোনও কাজেই আসবে না৷ টাকা খরচ করে ভূমিকম্প প্রতিরোধক বাড়ি বানানো । এজন্যই অনেকে খরচের ঝুঁকি নিতে চান না৷ ” কিন্ত সাইসমিক ফোর্স এর জন্য ডিজাইন না করে বাড়ি নির্মান করা হলে, যদি ভূ-কম্পনের মাত্রা (৪ .৫ -৫ রিখটার স্কেল বা তার বেশি ) হয় তাহলে এই ধরনের বাড়িও মোটেই নিরাপদ নয়৷
নতুন ভাবে গেজেট হওয়া বিএনবিসি ২০২০ এ স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের গাইডলাইন অনেকটাই বদলানো হয়েছে৷ ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা বিচার করে আগে গোটা দেশকে ৩ টা জোনে ভাগ করা হত৷ এখন সেটা চারটে জোনে ভাগ করা হয়৷

নিয়ম অনুসারে , যে কোনও বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রেই সিসমিক জোন অনুসারে সিসমিক ফোর্স বিচার করে ভবনের ডিজাইন করতে হবে৷ পুরোনো বাড়ি মেরামতের ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট গাইডলাইন তৈরি হয়েছে। কোড অনুযায়ী যেকোন ধরনের ভবন নির্মানের ক্ষেত্রে একজন দক্ষ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের মাধ্যমে ভবনের ডিজাইন এবং ডিটেইলিং করা লাগবে।
আবার যেসব ভবন নির্মানের ক্ষেত্রে কোন ধরনের সয়েল টেস্ট করা হচ্ছেনা। ভূমিকম্প প্রচণ্ড কম্পনের সৃ্ষ্টি করে। আর মাটির ভয়েডে যদি পানির উপস্থিতি বেশী থাকে তাহলে ভূমিকম্পের সময় সৃষ্ট প্রচণ্ড কম্পনের ফলে উচ্চ পানিচাপের সৃষ্টি হয় এবং মাটির দৃঢ়তা কমে যায়। যার ফলে সেই মাটি স্থাপনার লোড নিতে পারেনা।তাই স্থাপনা নির্মানের আগে জানতে হবে মাটির গুনাগুন সম্পর্কে। মাটির গুণাগুণ ঠিক না থাকলে একটি ইমারত দেখতে যত ভালো হোক না কেন, তা নিরাপদ হতে পারে না।যেমনঃ কোনো মাটি সদ্য ভরাট হলে এ ধরনের সমস্যা হতে পারে । তাই মাটি পরীক্ষা না করে এই ধরনের নির্মান নিরাপদ নয়৷ যে মাটির উপর বাড়ির স্ট্রাকচার দাঁড়িয়ে থাকবে , সেটাই যদি আপনি পরীক্ষা না করেন তাহলে ভবন অক্ষত থাকবে কি করে ??
এছাড়া যে ভাবে কার পার্কিং জোন রাখতে ফাঁকা কলামের উপর বাড়ি তৈরি হচ্ছে সেটা খুবই বিপজ্জনক৷ ভূমিকম্পের ফলে উপরের চাপ নিতে না পেরে এই ধরনের কংক্রিটের কলাম ভেঙ্গে যেতেই পারে৷ এছাড়াও ভূমিকম্প প্রবন এলাকায় ফ্ল্যাট প্লেট স্ল্যাব ব্যাবহার করলে সেটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ন হতে পারে।
আবার অনেকেই বাড়ি নির্মানের ক্ষেত্রে ব্যাবহার করে থাকেন নিম্নমানের নির্মান সামগ্রী। বাড়ি নির্মানের ক্ষেত্রে সঠিক মানদন্ডের নির্মান সামগ্রী ব্যাবহার করতে হবে,ব্যবহার করা রড কত সাইকেল লোড নিতে পারবে, তা পরীক্ষা করে নিতে হবে। ভূমিকম্পসহনশীলতার জন্য এমএস রডের গুণাগুণ নিশ্চিত করা খুবই প্রয়োজনীয়।
বাড়ছে বহুতল ভবন নির্মাণের প্রবণতা এতে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু যদি ইঞ্জিনিয়ারের পরামর্শ ব্যাতীত এবং নির্মানের সঠিক নিয়মনীতি অনুযায়ী বাড়ি নির্মাণ না করা হয় তবে তা হতে পারে খুবই বিপদজনক ।
“ একজন চিকিৎসকের পরামর্শ না নিলে হয়তো আপনার একার প্রান যেতে পারে কিন্তু একজন ইঞ্জিনিয়ারের পরামর্শ ছাড়া ভবন নির্মানের ফলে যদি ভবন ধ্বসে পড়ে তাহলে চলে যেতে পারে বহু প্রান । ”
একটি নিরাপদ আধুনিক ভবন নির্মাণের জন্য ভবন নির্মাণ বিধি,বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড – ২০২০ একটি সম্পূর্ণ প্যাকেজ। আমাদের উচিত একজন দক্ষ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের পরামর্শে, বিএনবিসি-২০২০ গাইডলাইন অনুসরন করে বাড়ি নির্মান করা , এবং অন্যকেও বিএনবিসি-২০২০ অনুসরন করে বাড়ি নির্মানে উৎসাহিত করা। এতে করে ভবন থাকবে নিরাপদ বেঁচে যাবে বহু প্রান এছাড়াও ভূমিকম্পের পর উদ্ধারকাজে পরিকল্পনা ও শৃঙ্খলা থাকতে হবে। সেনাবাহিনী, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। প্রস্তুতি ঠিক থাকলে জীবন বাঁচানো ও ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব।
লেখাঃ
মোঃ তৌহিদুল ইসলাম
উপজেলা সহকারী প্রকৌশলী
এল.জি.ই.ডি